You are currently viewing লেখাপড়া করার নিয়ম: বলেছেন সুশান্ত পাল

লেখাপড়া করার নিয়ম: বলেছেন সুশান্ত পাল

Share on social media

লেখাপড়া করার নিয়ম

এক। লেখাপড়া করতে ভালো না লাগলে তখন কী করা উচিত? সহজ উত্তর: লেখাপড়ার পেছনে আরও বেশি সময় দিতে হবে। মানুষ যা-কিছুর পেছনে সময় দেয়, তা একসময় তার প্রিয় হয়ে ওঠে। সময় দিলে যে-কোনো সম্পর্কেই আন্তরিকতা বাড়ে। লেখাপড়ার পেছনে সময় দিলে লেখাপড়ার সাথে ধীরে ধীরে আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হয়।

দুই। লেখাপড়া করে কিন্তু তেমন শান্তি পাওয়া যায় না; তবুও লেখাপড়া করতে হবে, কেননা লেখাপড়া শান্তি পাবার জন্য কেউ করে না, শান্তি আনার জন্য করে। নতুন কিছু শিখতে এবং মস্তিষ্কের গ্রহণক্ষমতা বাড়াতেই লোকে লেখাপড়া করে। সময়ে লেখাপড়া না করলে পরবর্তীতে যে পরিমাণ অশান্তির মধ্যে জীবন কাটে, তা যাপন করাটা খুব কঠিন। আগের কষ্টের চাইতে পরের কষ্টের দহন তীব্রতর।

তিন। নিয়মিতভাবে পড়তে বসতে হবে, নিজেকে বই-খাতা’র মধ্যে ধরে রাখতে হবে। তখন মস্তিষ্কের ঘরে লেখাপড়ার জন্য জায়গা তৈরি হবে। এতে সবচাইতে বড়ো যে অর্জনটা হয়, তা হলো: যে সময়টাতে তুমি লেখাপড়া করছ না, ওই সময়ে তোমার মস্তিষ্ক বিশ্রাম নেবে এবং মন অবচেতনভাবেই সেসব বিষয় নিয়ে ভাববে ও তোমাকে দিয়ে কাজ করাবে, যা যা তুমি লেখাপড়া করে শিখেছ। এভাবেই মানুষের চৈতন্য জেগে ওঠে এবং মানুষ সৃষ্টি করতে শেখে। শূন্যজ্ঞানে সৃষ্টিশীল হওয়া অসম্ভব।

চার। লেখাপড়ার জন্য কি খেলাধুলা বাদ দিয়ে দিলে ভালো? এর উত্তর হলো: খেলাধুলার মানে যদি হয় ফেইসবুকে বা অনলাইনে সময় কাটানো, তাহলে তা বাদ দিয়ে দেওয়া অবশ্যই ভালো। ঠিকভাবে খেললে দুই ঘণ্টার খেলা সোয়া দুই ঘণ্টা খেলাও কঠিন, অথচ পনেরো মিনিটের নিয়ত করে ফেইসবুকে ঢুকে সেখানে পনেরো ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া খুব সহজ। ফেইসবুক কখনোই লেখাপড়ার জায়গা নয়।

পাঁচ। লেখাপড়া করতে হবে কেন? এর কারণ, লেখাপড়া মনকে শক্তিশালী করে তোলে, প্রাণের অপ্রয়োজনীয় আবেগ ও বাসনা থেকে সরিয়ে নিয়ে মনকে একাগ্র করে রাখে। লেখাপড়ার পেছনে যখন কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন তার মন ও প্রাণ দুই-ই পড়ে থাকে লক্ষ্যে পৌঁছোনোর সাধনায়। এজন্য‌ই মন না চাইলেও লেখাপড়া করতে হয়।

ছয়। লেখাপড়া করতে গিয়ে কারও কারও জড়তা এসে যায়। এ থেকে মুক্তির উপায় হলো: তবুও লেখাপড়া করা। লেখাপড়া না করলে জড়তা আরও বেড়ে যায়। মস্তিষ্কের সচলতা লেখাপড়া করা ছাড়া অনেকটাই অসম্ভব।

সাত। যারা হতাশার কারণে লেখাপড়া করতে পারো না, তাদের বলছি: লেখাপড়া করলেই তুমি সমস্ত হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারবে। হাত-পা গুটিয়ে চুপচাপ বসে থাকলে তো আর হতাশা আপনাআপনি চলে যাবে না, তাই না? লেখাপড়াই আশাবাদের জননী।

আট। পড়তে বসে যখন কিছুই বোঝা যায় না, তখন আরও বেশি করে পড়তে হবে। কোনো কিছু বোঝার জন্য এর চাইতে সহজ রাস্তা আর নেই। কোনো কিছু না বুঝলে তা ছেড়ে না দিয়ে বরং বারবার পড়তে হবে। ছেড়ে দিলেই সব শেষ! ইংরেজি উপন্যাস পড়ার সময় প্রতিটি শব্দ না বুঝলেও ভাবটা ঠিকই ধরা যায়। মজার ব্যাপার, যে-সকল শব্দের অর্থ তুমি জানোই না, সেগুলির অর্থ‌ও তুমি বুঝে ফেলবে যদি পড়ার চর্চাটা ধৈর্য ধরে এগিয়ে নাও।

নয়। মন কখন প্রসারিত হয় জানো? লেখাপড়া করলে এবং অর্জিত শিক্ষা কাজে লাগালে। নিয়মিতভাবে এই চর্চা করলে কাজ হবেই হবে। লেখাপড়া-জানা মানুষের মন তাহলে প্রসারিত হয় না কখন? যখন মানুষ কেবলই পড়ে, কিছু শেখে না বা শিখলেও তা কাজে লাগায় না।

দশ। এই প্রশ্ন অনেকেরই মনে ঘুরপাক খায়: কোনটি বেশি জরুরি—সাধনা, না কি লেখাপড়া? উত্তরটা এভাবে দিই…যখন আমরা কোনো শিশুকে জিজ্ঞেস করি, “তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো—বাবাকে, না কি মাকে?”, তখন শিশুটি স্বাভাবিকভাবেই দ্বিধায় পড়ে যায়। মা ও বাবা উভয়ই শিশুর জীবনে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিশু বুদ্ধিমান হলে বলবে, “আমি দু-জনকেই সমানভাবে ভালোবাসি।” . . . আসলে এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না এবং এমন প্রশ্ন করাটাও অবিবেচকের কাজ। একইভাবে, লেখাপড়া ব্যাপারটা সাধনা থেকে আলাদা কিছু নয়, বরং তা সাধনারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে-শিক্ষার্থী লেখাপড়াই করে না ঠিকমতো, সে সাধনায় মন বসাবে কীভাবে?

এগারো। আমরা যখন কারও কাছ থেকে কিছু শিখি, তখন সবার আগে দরকার মন দিয়ে তাঁর কথাগুলি শোনা। এটা করতে না পারলে কাজে একাগ্রতা আসে না। তবে হ্যাঁ, যাঁর কথা কাজে লাগবে না, তাঁর কথা মন চাইলেও শোনার দরকার নেই। তাঁকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে অন্য কাজে সময় দিতে হবে। অনেকেই গুরু খোঁজার নাম করে গোরুর আশেপাশেই বেশি ঘেঁষে নিজেকে গুরু ভাবার লোভে। গায়ে পড়ে জোর করে গুরু হতে চায় যারা, ওদের থেকে সাবধান! কেউ গুরু কি গোরু, তা চিনতেও ভালো লেখাপড়া জানাটা খুব জরুরি।

বারো। মন কখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে? বেশি মানসিক কাজকর্ম করলে? অবশ্যই তা নয়। মন ক্লান্ত হয় জড়তা থেকে। আর মনের জড়তা আসে লেখাপড়ায় যথেষ্ট পরিমাণে সময় না দিলে। মনকে যে যত বেশি খাটিয়ে নিতে পারে, সে তত কম ক্লান্ত হয়। অলস মন‌ই ক্লান্তির ঘর।

তেরো। যারা পরিশ্রম করতে পারে না, প্রথমেই দেখতে হবে, তাদের শারীরিক কোনো সমস্যা আছে কি না। যদি থাকে, তবে সেটি সবার আগে সারাতে হবে। আর যদি না থাকে, তবে এটা নিশ্চিত, ওরা পরিশ্রম করতে পারে ঠিকই, কিন্তু করে না। লেখাপড়া খুশি হয়ে ওঠার কোনো রাস্তা নয়, তবে ঠিকভাবে এই রাস্তায় চললে আপাতগন্তব্যটি খুশি হয়ে ওঠার মতোই কিছু-একটা হবে—সেখানে পৌঁছে সেখান থেকেই আবার খুশিমনে যাত্রা শুরু। এসবের জন্য শুরুর দিকে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও লেখাপড়া করতেই হবে।

চৌদ্দ। আলো যেখান থেকে আসুক, আঁধার দূর করতে যেমন তা গ্রহণ করতে হয়, ঠিক তেমনি, যে-উৎস থেকেই জ্ঞান আসুক না কেন, তা গ্রহণ করার জন্য মানসিকভাবে তৈরি থাকতে হবে। এ পৃথিবীতে শিক্ষক এক জন‌ই, তিনি হচ্ছেন ঈশ্বর। তিনি সব জায়গাতেই আছেন, তাই নিজেকে তিনি প্রকাশ করেন নানান রূপে: প্রকৃতি, অভিজ্ঞতা, গ্রন্থ, দুঃখ, শিক্ষক, যে-কোনো মানুষ বা উৎস। জ্ঞানের উৎস জরুরি নয়, প্রাসঙ্গিকতা জরুরি।

পনেরো। ভালো কাজ করার জন্য ভালো রুচিবোধ থাকা জরুরি। লেখাপড়া করলেই রুচি উন্নত হবে, তা নয়, তবে লেখাপড়া রুচির বিকাশে সাহায্য করে। যে সুযোগ পেয়েও লেখাপড়া করে না, তার চাইতে সাধারণত তার রুচিই অধিক উন্নত, যে সুযোগের অভাবে লেখাপড়া করতে পারে না। তাই সুযোগ থাকলে লেখাপড়া করার মাধ্যমে রুচির উন্নয়ন ঘটানোর চেষ্টা করা উচিত।

ষোলো। জানার জন্য, শুরুতেই অনুভব করতে হবে যে, তুমি কিছুই জানো না। যে ভাবে, সে সব জানে, তার পক্ষে জানা কঠিন। এ ধরনের লোকের সঙ্গ ত্যাগ করলে ভালো। গ্লাসে নতুন জল ঢালতে হলে তো পুরোনো জলটা ফেলে দিতে হয়। যে-গ্লাস পুরোনো জল নিয়েই তুষ্ট, তার তো পূর্ণ হবারই দরকার নেই। প্রকৃত অর্থে জ্ঞানী ব্যক্তি নিজেকে সবসময়ই শূন্য ভাবেন। জ্ঞান কোনো চূড়ান্ত গন্তব্য নয়, বরং যাত্রাপথের একেকটি বিন্দু।

সতেরো। বইপত্র থাকা সত্ত্বেও যারা লেখাপড়া করে না, তাদের জীবনে দুঃখ অনিবার্য। পরনির্ভরশীল হয়ে তো আর সারাজীবন কাটানো যায় না, একটা সময় পর নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হয়। লেখাপড়া করে পা শক্ত করতে না পারলে তো তখন দাঁড়াতে গিয়ে হোঁচট খেতে হবে, খুঁড়িয়ে চলতে হবে। এটা শুরুতে না বুঝলে পরে পস্তাতে হয়।

আঠারো। আলস্য কাটাতে চাইলে শরীরকে নীরোগ রাখতে হবে। এরপর শরীরে শক্তি এলেও যদি আলস্য না কাটে, তাহলে লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে মনের খুশিমতো কোনো কাজ করতে হবে এমনভাবে, যাতে করে সেই কাজের পেছনে ব্যয়িত সময় লেখাপড়ার পেছনে ব্যয়িত সময়ের শতকরা দশ ভাগের বেশি না হয়।

লিখেছেনঃ

সুশান্ত পাল,

১ম স্থান অধিকারী ও সর্বোচ্চ মার্কপ্রাপ্ত ,৩০ তম বিসিএস, সাবেক শিক্ষার্থী চুয়েট সিএসই।

 


Share on social media

Leave a Reply